বালতিতে নীল গুলে রেখেছি।একটা চড়ুই জল ভেবে উড়ে এল।নীল জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল।তারপর দেখল চারপাশ।বুঝল না আমি থেকেও নেই।টুপ করে একটা ডুব।
তারপর উড়ে গেল।পাশের কদম গাছটি নতুন।দু-চারটে ফুল ফুটেছিল।অপুষ্টিতে ঝরে গেছে। সে যেন ডালপাতা দুলিয়ে চড়ুইটিকে ডাকছিল।শিশু যেমন টলমল পায়ে মায়ের কাছে ফিরে যায়,চড়ুইও তেমন গেল,উড়ে।
শীতের সকাল।বউ কিরে-কান্ড দিয়ে গেছে,পরিস্কার জামাকাপড় পরবে।দিনদিন চেহারা কেমন ভিকিরির মত হয়ে যাচ্ছে,
পোশাক-আশাক যদি ভাল হয়,তবুও লোকের কাছে মান থাকবে।আর হ্যাঁ,জামাকাপড় যেন নিজেই কাচবে।
কোন মেয়েকে ডাকবে না।
--আমাকে কি তোমার খারাপ লোক মনে হয়?
--খারাপ মানে একেবারে বাজে,বাবা যে কোন আক্কেলে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল।হাড়মাস সব জ্বলে গেল।
--আমি,আমি কি অন্যায় করেছি তোমার সাথে?
--আন্যায় কর না বলেই তো রাগ হয়,বাবার কাছে গিয়ে তোমার সমন্ধে অভিযোগ খুঁজে পাইনে।
--বেশ তো,তুমি যখন থাকবে না,আমি বস্তি থেকে কোন একটা মেয়েকে ডেকে আনব।সে আমার কাপড় কাচবে,রান্না করবে,খাবার খুলে দেবে।তুমি ফিরে বস্তির অন্য মেয়েদের কাছে আমার নামে হাজার কেচ্ছা শুনবে।ব্যাস,বাবার কাছে রিপোর্ট।প্রতিটি সকালে ভিখিরির চেহারা দেখা থেকে রেহাই পাবে। কি মজা!
--তোমার মজা টের পাওয়াচ্ছি আমি।ওসব মেয়েছেলে-টেলে কোনমতেই এবাড়িতে ডাকা চলবে না।
--ডাকলে দোষ কি।
--না,ডাকবে না।বাড়ির সব কাজ নিজেই করবে।
--কিন্তু আমি যে রান্না করতে জানি না,ঠিক আছে,হোটেলে খেয়ে নেব।
--না,ওসব হোটেল ফোটেল চলবে না।
--কেন।হোটেলে অসুবিধা কোথায়?
--তুমি যা কিপটে লোক,ঠিক রেললাইনের পাশের সস্তার হোটেল গুলোতে খাবে,বাপরে কি নোংরা,থালা-বাটিও ঠিক মত ধোয় না।
--বেশ,আমি পাঁচমাথার দামী হোটেলে খাব,থালা নয়,ওরা পদ্মপাতায় ভাত দেয়।
--ও,ওমনি করে জমানো টাকা গুলো সব খরচ করবে।উঁহু তা হবে না।
--আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো,আরে বাবা জমানো টাকা গুলো তো আমার বাবার।আমি আমার বাবার টাকায় খাব,তাতে তোমার আপত্তি কেন?
--তোমার বাবা শুধু তোমার বাবা নাকি আমারও তো শ্বশুরমশাই।তাঁর টাকা যাতে নয়ছয় না হয় তা তো আমাকে দেখতে হবে।
--তাহলে কি আমি না খেয়ে থাকব?
--না,তা কেন থাকবে,তুমি রোজ নিজে রাঁধবে।
--কি রাঁধব?
--খিচুড়ি।
--উঁহু তা হবে না,খিচুড়ি খেলে আমার হাত-পায়ে খিঁচুনি ধরে,তা ছাড়া আমি খিচুড়ি তৈরী করতেই জানি না।
--পৃথিবীর সব থেকে সহজ রান্না হচ্ছে খিঁচুড়ি রান্না করা।
--না,না,খিচুড়ি,আমার সহ্য হবে না।
--হবে না মানে আলবৎ হবে।আমার মত মেয়েকে সহ্য করতে পারছো আর খিচুড়ি সহ্য করতে পারবে না।
--এতক্ষণে একটা দামী কথা বললে।
--আমি সবসময় দামী কথা বলি কিন্তু তোমরা দুজনে,মানে আমার বাবা আর তুমি কিছুতেই তা বুঝতে পারো না।
--হবে হয়ত,আমাদের বোধবুদ্ধি তোমার বুদ্ধাঙ্কের স্কেলের নয়।
--তুমিও এবার একটা দামী কথা বলেছো।বেশ,যা-য়া বলছি মন দিয়ে শোন।
--ঠিক আছে বলে যাও।
--বলব কি,তুমি তো দেখছি তখন থেকে কমপিউটারে কি সব টাইপ করছো,আমার কথা বোধহয় একটাও শুনছো না।
--না শুনলে জবাব দিচ্ছি কি করে।
--তা-ও তো বটে,হ্যাঁ কি বলছিলাম যেন,খিচুড়ি রান্নার সহজ নিয়ম চাল,ডাল,সব্জী ভাল করে ধুয়ে প্রেসার কুকারে রাখবে।
গ্যাস জ্বালাবে,দু-তিনটে সিটি মারলেই গ্যাস বন্ধ।ঠান্ডা হলেই খেয়ে নেবে।
--নুন না দিয়েই খাব?
--ধ্যাৎ ,তোমার না রামছাগলের মত বুদ্ধি।
--রামছাগলের দাড়ি আছে।
--দাড়ি থাকলে তো তুমি মাঠে-মাঠে দোড়ে বেড়াতে।
--নাই,তাই তোমার শাড়ি ধরে টানাটানি করি,তাই না?
--ওটাই তো তুমি জানো,আর কিছু জানো কি?
--হ্যাঁ জানি।
--কি জানো?
--তুমি তোমার বাবার কাছে ডিভোর্সের দরবার করতে যাচ্ছো।
--কে,কে,বললে তোমাকে এসব?
--কে আর বলবে,তোমার চিল-চিৎকারে এবাড়িতে তে তো কাক-পক্ষীও আসে না।
--বেশ করি,চিৎকার করি,একশবার করব।এটা আমার শ্বশুরমশাইয়ের বাড়ি।
--আচ্ছা,আমার বাবা তো তোমার জন্মের আগে মারা গেছেন,যাকে চোখে দ্যাখোনি তার প্রতি এত ভক্তি হল কি করে।
--আমার বাবার প্রতি তোমার অত ভক্তি কিসের সেটা আগে বল,শ্বশুর-জামাই তো মনে হয় না,ঠিক যেন বাবা-ছেলে।
--আরে শ্বশুরও তো বাবার মত।
--খবরদার আমার বাবাকে বাবা বলবে না,আমি তোমার বাবাকে একবারও বাবা বলেছি?
--না,তা বলোনি,তবে আমি বলি,তোমার আড়ালে তোমার বাবাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকি।
--ঘোরতর অন্যায়,আমার বাবার বিষয়-সম্পত্তি সব হাতিয়ে নেবার চক্রান্ত।
--আমি ছাড়া তাঁর আছেই-বা কে?
--কেন আমি আছি। আমি তাঁর একমাত্র মেয়ে। ওহ নিজের বাবার সব সম্পত্তি ভোগ করছে আবার আমার বাবার সম্পত্তির দিকে চোখ।
--বাবাকে যদি অতই ভালবাস,নিজের কাছে এনে রাখলেই পারো।
--আনতাম,একশবার আনতাম।আনি না কেন জানো?
--কেন?
--তোমার আদিখ্যেতার জন্যে।অবশ্য আদিখ্যেতা তুমি একা কর না,আমার বাবাও করে।আহা দুজনের দেখা হলে কত বাবা-বাবা,ছেলে-ছেলে,ভাব।আর আমি যেন কোন বানের জলে ভেসে আসা।
--বিচিত্র নয়,উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে তোমার জন্ম,সেবার কিন্তু বিশাল বন্যা হয়েছিল,কত লোকের ঘরবাড়ি,ছেলেপুলে,
গরুমোষ সব ভেসে গেছিল।
--কক্ষোনো না,তাহলে আমার নাম’বন্যা’ রাখতো আমার বাবা।কিন্তু নাম কি রেখেছে,ঝিলম।
--আহা ঝিলম উত্তর ভারতের একটা নদী।বন্যার কারণ নদী আর তুমি বন্যার ফল তাই এ ইনটু সি সুত্র অনুযায়ী,
তুমি ঝিলম আবার বন্যাও।
--ওসব সুত্রমুত্র আমার সামনে কপচিও না,আমার মাথা ধরে যায়।
--বেশ,তাহলে একটু সহজভাবে ব্যাখ্যা করি,তোমার জন্মের সময়ে হিন্দী সিনেমায় নিলম নামের এক নায়িকা
হিট হয়েছিল,তাই নিলমের সাথে অন্তমিল রেখে তোমার নাম ঝিলম।
--একদম বাজে কথা,আমার বাবা উত্তম-সুচিত্রার ফ্যান,তেমন কিছু হলে তিনি আমার নাম সুচিত্রা রাখতেন।
--এই তো হয়ে গেল,এ প্লাস বি হোলস্কোয়ার,তারমানে তুমি তোমার বাবার মেয়ে নয়,কুড়িয়ে পাওয়া।
--যুক্তি তো খুব খারাপ দাওনি,দাঁড়াও বাবাকে ফোন করি।
শ্বশুরমশাইয়ের মোবাইলের রিংটোনটা বড় অদ্ভুত,‘একটুখানি অপেক্ষা করুন মিস্টার খান এখন নামাজ পড়ছেন।‘
শ্বশুরমশাই সম্ভবত এখন গোসল করছেন।তিনি অবশ্য বলেন,আমাদের প্রতিটি কর্মই এবাদত,যদি তা ঠিকমত করা হয়।
বউ ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিল বিছানায়।আবার আমাকে নিয়ে পড়ল,হ্যাঁ,কি যেন বলছিলাম,কি যেন বলছিলাম।ওর কি যেন বলছিলাম,কি যেন বলছিলাম শুনতে-শুনতে আমারমাথা খারাপ।হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বউয়ের মাথার শিরা-উপশিরা সক্রিয় হয়ে উঠল,খিচুড়ি,ওহ হ্যাঁ,খিচুড়ি,চাল,ডাল,আলুর সাথে নুন,হলুদ,তেল দেবে আন্দাজ মত।
--আমার আন্দাজের উপর তোমার ভরসা আছে?
--তুমি খাবে তাতে আমার ভরসার কি দরকার।
--তাও তো বটে। তাহলে আমি সস্তার হোটেলে খেলে তোমার আপত্তি কিসের?
--আপত্তি আছে,অনেক রকম আপত্তি আছে,নম্বর এক,কোন মেয়েকে বাড়িতে কাজ করতে ডাকবে না।কোন
ভিখিরি দরজায় এলে ভিক্ষা দেবে না।
--এটা একরকম নির্যাতন,ভিক্ষা না পেলে ও-বেচারারা খাবে কি।
--কে কি খাবে তা নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। ভিখিরির জন্য আরো পাঁচবাড়ির দরজা খোলা আছে,আমার শুধুমাত্র একটাই দরজা।
--তোমার কি ধারণা ভিখিরিকে আমি নিকে করব?
--না,তবে ভিকিরিরা তোমার ঘটকালি করবে,তা বেশ বুঝতে পারি।
--আমার চেহারা দিন-দিন ভিকিরির মত হচ্ছে তাই বুঝি ভিকিরিরা আমার জন্যে পাত্রী খুঁজতে বের হবে?
--ওসব বাজে যুক্তি ছাড়ো,আমি যা বলছি মন দিয়ে শোন,ফেরিওলা রাস্তায় হাঁক দিলে বাইরে বের হবে না।
--কেন,ফেরিওলা কি সীতার মত আমাকে হরণ করবে?
--একদম বাজে বকবে না।যা বলছি মন দিয়ে শোন,রাত জেগে কম্পিউটারে কাজ করবে না,নটার মধ্যে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
--খিচুড়ি খেয়ে যদি ঘুম না আসে?
--ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধোবে,তারপর আমার কথা ভাববে।দেখবে মনে হবে,আমি তোমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।দিব্যি ঘুম এসে যাবে।
--ঘুম না এলে তুমি আসবে তো?
--হ্যাঁ গো হ্যাঁ আসবো,তুমি মনপ্রাণ দিয়ে ডাকলে আমি কি না এসে থাকতে পারি?
পনেরো দিন আগে চলে গেছে ঝিলম।একটা ফোনও করেনি। তবু সে যা-যা বলে গেছে মেনে চলেছি অক্ষরে-অক্ষরে। এ-যেন সেই রুপকথার রাজকন্যার গল্প,এই-এই কাজ যদি তুমি ঠিকঠাক করতে পারো তবেই আমাকে ফিরে পাবে।
নীলগোলা জলের বালতির কাছে গেলাম।দেখি খানিকটা লাল হয়ে গেছে।নীল রং লাল হয় কেন?চড়ুইয়ের উড়ে
যাওয়ার রাস্তা ধরে কদম গাছের কাছে যাই।দু-এক ফোঁটা নীল,দু-এক ফোঁটা লাল।এমন তো হওয়ার কথা নয়।নীল
যন্ত্রণার প্রতীক,লাল রক্তাক্ত বা ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার অবিব্যক্তি?আমি না হয় ক্ষতবিক্ষত হই,চড়ুই কেন হবে?বালতির জলে হাত ডোবালাম।দেখি একটা কাঁচের টুকরো।আমারআঙুল ফুটে রক্ত বের হচ্ছে।চড়ুই আর আমি কি এখন একসারিতে?
সদর দরজায় কলিংবেল বাজছে। বললাম,আমি নিজেই ভিকিরি,কাউকে ভিক্ষা দিই না গো।
বাইরে থেকে আওয়াজ এল,আমি ভিকিরি নই বাবা।
--ওহ,তবে নিশ্চয় ফেরিওলা,না,বাপু,ফেরিওলা ডাকলে আমার বাইরে যাওয়া নিষেধ আছে।
--আমি তোমার শ্বশুর।
--ওহ আপনি,আপনি কবে ফিরলেন?
বলতে-বলতে আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের মত চেহারা হয়ে গেছে ঝিলমের আব্বার।গলার স্বরেও আশ্চর্য পরিবর্তন। বললেন,এই তো এখনই ট্রেনে নামলাম।ভাবলাম,সংবাদটা তোমাকে দিয়েই যাই।
--কবে আসবে ও?
--কোন আশা নেই। অরফানেজের বড় ডাক্তারবাবু বললেন,এসব রুগী বছরের পর বছর একই অবস্থায় থাকে।তা তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে না তো বাবা?
--না,না,আমার আবার কষ্ট কিসের।দু-বেলা খিচুড়ি রেঁধে খাচ্ছি।বেশী থালাবাটি ধোয়ার ঝামেলা নেই।একটু আগে কাপড় কেচেছি,নীলে ডোবাবো,তা কি আশ্চর্য দেখুন একটা চড়ুই কোথকে এসে ডুব মারল।ওর জন্যে কে কাঁচের টুকরো রেখেছিল কে জানে,ওর বুকের রক্ত আর আমার আঙুলের রক্তের রঙ একই,লাল।
--বুঝতে পারছি একজন মানসিক রোগীর কাছে থেকে তুমিও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছো।
--না,না,আমি মোটেও ভারসাম্য হারাইনি।জানেন সেদিন রাতে দেখছি,আমার টুঁটিতে খুব ব্যথা,ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি।
একটু পরে বুঝলাম আমার গলায় ফাঁস লাগিয়ে কেউ টানছে।কোনরকমে হাত দিয়ে দড়ির ফাঁস আলগা করলাম। তারপর দেখি হি-হি
করে হাসছে ঝিলম।বলছে,একদিন এমনি করেই তোমাকে মেরে দেব।
আমি বিন্দুমাত্র রাগিনি। তবে আপনি গুরুজন,আপনাকে জানানো কর্তব্য বলেই জানিয়েছি।ওর জন্যে আমার মরে গিয়েও সুখ।
--বালাই-ষাট মরবে কেন,আমি তোমাকে একটা কথা বলি,আমার মেয়েকে হয়ত অরফানেজেই থাকতে হবে সারাজীবন।তুমি কেন
মিছিমিছি কষ্ট করবে?
--কষ্ট,আমার কোন কিছুতেই কষ্ট নেই জানেন,খিচুড়ি বলুন কিম্বা চড়ুই পাখি,ভিকিরি কিম্বা ফেরীওলা সবই আমার জীবনের সথে একসুতোয় বাঁধা।
-- না বাবা,তোমার আমি আবার বিয়ে দেব।
--বিয়ে দেবেন? কিন্তু ও আমাকে যা-যা শর্ত দিয়েছিল তার সবই আমি মেনে চলেছি অক্ষরে-অক্ষরে।ও আমাকে কথা দিয়ে গেছে,
সব মেনে চললে ও ফিরে আসবেই।যদি ফিরে আসে তখন আমি কি করব?
*
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




